আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রে যখন আবারও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে, তখন এশিয়ার অনেক দেশ যেন শীতল হাওয়ায় আচ্ছন্ন। জাপান ও বাংলাদেশকে বাদ দিলে মহাদেশের শীর্ষ দশ অর্থনীতিতে গড়ে মুদ্রাস্ফীতির হার মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীনে ভোক্তা মূল্য একেবারেই কমে গেছে, একই অবস্থা থাইল্যান্ডেও। ফিলিপাইনসহ আরও কয়েকটি অর্থনীতি মুদ্রাসংকোচনের কাছাকাছি অবস্থায়। এমনকি, যে ভারতে সবসময় মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বেশি, সেখানেও জুলাই পর্যন্ত এক বছরে দাম বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১৭ সালের পর যা সবচেয়ে কম।
মুদ্রাসংকোচন বা ডিফ্লেশন হলো এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে পণ্য ও সেবার দামস্তর ক্রমাগত হ্রাস পায়। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তবে মুদ্রাসংকোচন বেশি হলে তা অর্থনৈতিক মন্দা বা ‘ডিফ্লেশনারি স্পাইরাল’ তৈরি করতে পারে, যেখানে মানুষ খরচ কমিয়ে দেয় ও উৎপাদন কমে যায়।
অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যসীমার ভেতরে, কিন্তু পাঁচটি দেশে তা এর নিচে নেমে গেছে। আর যেসব দেশে লক্ষ্যসীমার ভেতরে রয়েছে, সেখানেও মূল্যস্ফীতি হ্রাসের প্রবণতা স্পষ্ট।
অনেকে হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ককে এর জন্য দায়ী করবেন। কিন্তু তত্ত্ব অনুযায়ী, এসব শুল্ক এশিয়ার ওপর চাহিদার ধাক্কা হয়ে আসার কথা, যাতে রপ্তানি দাম ও উৎপাদন উভয়ই কমে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সে রকম কিছু ঘটেনি। বরং শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে এশিয়ার বহু প্রতিষ্ঠান দ্রুত চালান বাড়িয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়ার রপ্তানি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। তাছাড়া, এশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি কমার ধারা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধেই, ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অনেক আগে। ভবিষ্যতে তার শুল্ক হয়তো দাম কমাতে পারে, কিন্তু গত বছরের প্রবণতা তার শুল্কের প্রভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আবার জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বাজারও শীতল প্রভাব ফেলেছে। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক ও তাদের মিত্ররা খনন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তেলের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধ ও তীব্র গরমে ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে বছরের পর বছর যে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল, তাও কমেছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত এশিয়ার শীর্ষ দশ অর্থনীতিতে (জাপান ও বাংলাদেশ বাদে) খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল গড়ে ৫ শতাংশ। জুলাই নাগাদ তা নেমে এসেছে ১ শতাংশে। এই পতন কেবল ‘বেস ইফেক্টের’ কারণে নয়, অর্থাৎ আগের বছরের উচ্চ মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করার কারণে নয়। চীনে শূকরের অতিরিক্ত সরবরাহের ফলে শূকর মাংসের দাম কমেছে, যা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ১০ লাখ শূকর কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে, পুরো এশিয়াজুড়েই মজুরি বৃদ্ধির হার ধীর গতির। অনেক দেশে শ্রমশক্তি বৃদ্ধির কারণে মজুরির ওপর চাপ পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্যানথিয়ন ম্যাক্রোইকোনমিকসের বিশ্লেষক মিগুয়েল চানকো। ফিলিপাইনে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে, আর ভারতে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
২০২২ সালের বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির দুঃসহ স্মৃতি, যা এশিয়ার প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, হয়তো আরও বেশি মানুষকে শ্রমবাজারে ঠেলে দিয়েছে। এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররাও যেন পুনরাবৃত্তির ভয়ে অতিরিক্ত সতর্ক। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অ্যালেক্স হোমসের মতে, সাধারণভাবে তাদের আর্থিক নীতি চাহিদার ঝুঁকির তুলনায় অত্যন্ত কঠোর।