হাফিজ ছিদ্দিকী: আমিত্ব মিথ্যা আর ভূলে ভরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যার শুরু থেকে অদ্যাবধি অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। মুক্তিসংগ্রামের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব আর স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৬২ সাল থেকে তলে তলে রূপরেখা (নিউক্লিয়াস) এঁকেছিলেন সিরাজুল আলম খানের সাঙ্গপাঙ্গরা। ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে জিতেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ক্র্যাকডাউন চালালো ইয়াহিয়া খান। আক্রান্ত বাংগালীদের অসহায়ত্বে বেংগল রেজিমেন্ট তথা মেজর জিয়ার (রিভোল্ট) বিদ্রোহ জনগনকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দেয়। ২০ দিনের মাথায় মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারের সূচনা। ভারত দিলো সীমান্তের পর্দা খুলে। ক্রমশই দেশের শহর থেকে অজগাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতার যুদ্ধের ঘোষনা। কার ছেলে কার বাপ, কার ভাই কার স্বামী এই জীবন যুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করে সীমান্তের এপারে ও ওপারে লড়াইয়ে যুক্ত হলো তাও ছিলো অঘোষিত। যে যার মতো করে আপন ইচ্ছায় মাতৃভূমি রক্ষায় লড়াইয়ে অবতীর্ণ।
সংগ্রামের নেতা অঘোষিত ভাবে গ্রেফতার হয়ে চলে গেলেন লাহোর জেলখানায়। তাঁর পরিবার পরিজন আশ্রয় পেলেন পাক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্ত হয়ে। সাধারণ জনগণ বাপ, মা, বৌ, বাচ্চা ফেলে জীবন ঝুঁকিতে নেমে পড়লেন রণাঙ্গনে। কেউ সম্মুখ যোদ্ধা কেউবা গেরিলা যোদ্ধা। ১১টি সেক্টরে বিভক্ত বাঙালি রেখেছে লড়াই অব্যাহত প্রায় ৯ মাস। বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছে দেশের জনগণ তাই কেউ নফল নামাজ কেউ নফল রোজা রেখেছে স্বাধীনতার জন্য।
ওঁৎ পেতে থাকা চাতক পাখীরা ভাবলো এটাই চুড়ান্ত সুযোগ তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েই কয়েকটি বিমান হামলা করেই পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে মহা যুদ্ধ নায়কের ভান করে। এক সপ্তাহের মাথায় জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেন। তড়িঘড়ি করে ১৬ ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনা কমান্ডার জেনারেল অরোরা রেসকোর্সে আয়োজন করলেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বদেশের মালিক নেই হোষ্ট নেই , গেষ্টরাই সকল আয়োজক। আমাদের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এখনো সিলেটের রণাঙ্গনে। যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক থাকবেন প্রধান পক্ষ অথচ তাঁকে ঢাকায় আসতে দেয়া হলোনা। যুদ্ধের আত্মসমর্পণ হলো বহিরাগত মিত্রশক্তির হাতে। এই চুক্তির মাঝেই আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ। আজো যেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ১৫ হাজার কোটি ডলারের গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র ও মিল ফ্যাক্টরির যন্ত্রাংশ লুটের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে গিয়ে গ্রেফতার হলেন ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল। শেখ মুজিব বিবিসির সিরাজুর রহমানের মাধ্যমে জানলেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তিনি ১০ ই জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেই পরামর্শ ও শপথ ছাড়াই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন। সেই থেকেই আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় হরিলুটের এই খেলা এখনো চলমান দেশের প্রতিটি অর্গানে। প্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে হয় যেই নেতা যুদ্ধই দেখেন নাই তিনি হঠাৎ লোক মুখে শুনে শহীদ সংখ্যার বিতর্কিত অংক দিয়ে ইতিহাসে আমাদেরকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে ৩ লক্ষ আর ৩০ লক্ষে বিভাজিত করে সকল প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছেন।
দীর্ঘ দিনের এই অরাজকতা চলমান থেকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পন্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায় তরুণ প্রজন্মের ছাত্রজনতা। ২০২৪ সালের জুলাই আগষ্টের গণহত্যা বিপরীতে গণ-অভ্যূত্থান সংঘঠিত হলো। পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ইন্টেরিম বা কেয়ারটেকার সরকার ইতিহাসে দেখিনি বরং বিপ্লবী সরকার দেখেছি। আমাদের বিপ্লবীদের উচিৎ ছিলো তাদের বিপ্লবী ফরমান জারি করে প্রতিটি সেক্টরে সকল ফ্যাসিবাদের কুশীলব দের সরিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করে দেশকে নতুন আঙ্গিকে একটি আধুনিক বাস্তব সম্মত নতুন সংবিধান উপহার দেওয়া। কারণ বিপ্লবের পর কোনো সরকার থাকেনা, সংবিধান থাকেনা। এই পূনঃগঠনে কোনো কোনো দেশে স্থিতিশীলতা আসতে ৫/৭ বছর লেগেছিল। তবুও আমলাতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদীদের পূনঃউত্থান হতে দেয়নি।
আমাদের বিপ্লবীদের মনোনীত সর্বজনীন সিলেক্টেড অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে বসানোর আগেই তাঁর কর্ম নির্ধারণ করা দরকার ছিলো। তিনি তথাকথিত ইলেকশনের দায়িত্বশীল সরকার নয়। তিনি দেশের পূনঃগঠনের সরকার তথা বিপ্লবীদের সরকার। ঐ যে আমার লেখার শুরুতে বলেছিলাম আমাদের আমিত্ব আমিত্ব ভুল আর ভূলে ভরা দেশের জনগণের ভাগ্য জগদ্দল পাথরের নিচেই আটকে আছে। আমাদের এই জাতির বিবেকের চাইতে আবেগের মূল্য বার বার দিতে হবে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ ছিদ্দিকী