শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক তোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই গাজীপুরের শ্রীপুরে ইসরাফিল নামের যুবককে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার নেতৃত্বে বসতঘর থেকে তুলে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে গায়ে গরম পানি ঢেলে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
১৩দিন চিকিৎসা নেয়ার পর বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইসরাফিল মৃত্যুবরণ করেন। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক মোঃ ইসরাফিল (২৪) জেলার শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের বাঁশবাড়ি গ্রামের মোঃ নাসির উদ্দিনের ছেলে।
নিহতের স্বজনরা জানান, গত ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার নিজ বাড়ির বসত ঘরে ঘুমিয়ে ছিল ইসরাফিল, সকাল ৭টার কিছু সময় পর, এলাকার সোহাগসহ কয়েকজন যুবক তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে স্থানীয় বেপারী বাড়ি জামে মসজিদের চুরি যাওয়া ব্যাটারি সম্পর্কে জানতে চায়। পরে তাকে নিয়ে যায় বাড়ির অদুরে শৈলাট পশ্চিমপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে নিয়েই তার হাত-পা রঁশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর ইসরাফিলের উপর চলে ব্যাটারী চুরির অপবাদে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। লোহার রড দিয়ে পায়ের পাতা থেকে শুরু করে পিঠ পর্যন্ত পেটানো হয়। পরে কোমড়ের নিচে গরম পানি ঢেলে দেয়। গরম পানিতে যুবকের দুই পায়ের পাতা থেকে কোমর পর্যন্ত ফুসকা পড়ে যায়। এমন অবস্থায় নির্যাতনকারীরা ইসরাফিলের বুকে, পেটে, পিঠে লাথি মারতে মারতে চোর পেটানোর উৎসব শুরু করে, করতে থাকে উল্লাস। পুরো ঘটনায় নিহতের কোন স্বজনদের কাছে যেতে দেয়নি। তারা কাছে যেতে চাইলে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর কামরুল হাসান লিটন, বাবুল মন্ডল, শফিকুল ইসলামের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৬ থেকে ৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেন মো. ইসরাফিলের বাবা। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওই অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি পুলিশ। মূল অভিযুক্ত কামরুল হাসান লিটন (৫০) শৈলাট গ্রামের মৃত মনির উদ্দিনের ছেলে। সে গাজীপুর ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, কামরুল হাসান লিটনের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন ইসরাফিলের ওপর ওই নির্যাতন চালান।
নিহতের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, বসত ঘরে ঘুমিয়ে থাকা আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে শৈলাট পশ্চিম পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে আমার ছেলেকে কয়েক ঘন্টা ব্যাপী পেটায়। পেটানোতেও ক্ষান্ত হয়নি তারা, এক পর্যায়ে চায়ের দোকান থেকে গরম পানি নিয়ে আমার ছেলের ওপর ঢেলে দেয়। এতে কোমড়ের নিচ থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুসকা পড়ে যায়। এসময় আমার ছেলে পানি পান করতে চেয়েছিল, তার জীবনটা ভিক্ষা চেয়েছিল, কিন্তু জীবন ভিক্ষা তো দুরের কথা তারা পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। আমরা এত চেষ্টা করেছি তবুও নির্যাতনকারীদের মন গলাতে পারিনি। আমাদের দেখলে নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতো।
নিহতের শতবর্ষী দাদী মহর জান অভিযোগ করে বলেন, আমার নাতীকে বাড়ি থেকে স্কুল মাঠে ডেকে নিয়ে সকাল ৮ টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৪ঘন্টা ধরে নির্যাতন করে। আমি কত বার যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু ওরা (নির্যাতনকারীরা) আমাকে বারবারই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে।
নিহত ইসরাফিলের চাচা আব্দুর রহিম অভিযোগ করেন, মারধরের পর একটি ভ্যানে তুলে ইসরাফিলকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় থাকার তিনদিন পর আমার ভাতিজাকে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে গত ১৬ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন চিকিৎসকরা। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ইসরাফিল মারা যান।
মারা যাওয়ার পরপরই অভিযুক্তরা এলাকায় গা ঢাকা দিয়েছে। কামরুল হাসান লিটনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যাওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে গাজীপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ইসরাফিলের উপর চালানো নির্যাতন সম্পর্কে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জেনেছি। নির্যাতনের শিকার ইসরাফিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার মারা গেছে। তবে এ ঘটনায় কামরুল হাসান লিটন আমাকে কিছুই জানায়নি।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোস্তাক আহমেদ জানান, ইসরাফিল নামে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। স্বজনদের আবেদনের ভিত্তিতে ময়নাতদন্ত করা হবে।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: জয়নাল আবেদীন বলেন, নির্যাতনের ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এবিষয়ে পরবর্তীতে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পূর্বের দেয়া লিখিত অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে।