হাফিজ ছিদ্দিকী : ১৯৪৭ সালে মুসলিমদের দুইটি ভগ্ন এলাকা জোড়াতালি পাকিস্তানের জন্য ছিলো একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের ফসল। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের পথচলার প্রতিটি বাঁকে ভারতের “র” এর নিজস্ব পরিকল্পনা আগাতে থাকে। একবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থানরত শেখ মুজিবুর রহমানকে উচ্চস্বরে কটুক্তি ও তিরস্কার করে লবি থেকে বের করে দিলেন। বিষয়টি একান্ত গোপনীয় হলেও মোহাম্মদ টি হোসেনের রচিত বই ” দুই পলাশী দুই মীর জাফর” এর একটি প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছিলো পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার প্রস্তাবনা। রাইটার যেটাকে দিল্লির প্রেসক্রিপশন বলেই উল্লেখ করেছিলেন। তাঁরই ধারাবাহিকতায় বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার ও ডাঃ কালিপদ নাথ বৈদ্য ছিলো নাটের গুরু।
নানা দাবি আদায়ের অজুহাত নানা আন্দোলন শেষতক ৬ দফা ১১ দফা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। সোনার বাংলা শ্বশানের দায় চাপিয়ে যদিও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ মুজিব তাঁর অবস্থান থেকে পল্টি মারা পরিলক্ষিত হয়। ৭ই মার্চের অসমাপ্ত ভাষণে ক্ষুব্ধ হয় তরুণ ছাত্র নেতারা। সন্ধার পর এই নেতারা শেখ মুজিবের ৩২ নাম্বারে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তখন শেখ মুজিব সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশে তিনি পাক সেনাদের হাতে ধরা দিয়ে পাকিস্তান চলে যান। জাতির এই দূর্যোগে ও গণ-হত্যার প্রেক্ষিতে মেজর জিয়া প্রথমে নিজ নামে ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধেই শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
৯ মাস যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক সেনাদের আ্ত্মসমর্পনের পর ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারী দেশে কার্য্যত কোনো সরকার ছিলোনা। এই সময়ে অবাংগালী ও কলাবরেটরদের সম্পদ লুটপাট ও গণ-হত্যার মহড়া চলে। ঢাকা ষ্টেডিয়ামে জড়ো করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয় যাদের অধিকাংশই ছিলো বিহারী। ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব লন্ডন হয়ে দেশে এলেন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্স করে। একদিকে মুজিবের প্রত্যাবর্তন আর স্বাধীনতার উল্লাসে সবাই একাকার। সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা স্বশস্ত্র অবস্থায় ঢাকামুখী হলো অস্ত্র সমর্পনের জন্য। অন্তরালে চলে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধ আর গ্রুপিংয়ের কানাঘুষা। পরিপূর্ণ অস্ত্র সমর্পণ হলোনা। অনেকেই সেই অস্ত্র নিয়ে আপন ঠিকানায় ফেরৎ গেলো।
প্রবাসী সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা এই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। শেখ মুজিবের চার খলিফা খ্যাত চার নেতার বিভাজন। একদিকে রাষ্ট্র মেরামতের উপাদান মুজিববাদ অপরদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে দেশ পরিচালনার দীপ্ত শপথ।
ছাত্রলীগের দ্বিধা বিভক্তির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ঘোষনা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার শ্লোগানে ঢাকসুর ভিপি ও জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান আ স ম আবদুর ও অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ পল্টন ময়দানে সম্মেলনের আয়োজন করে। পাল্টাপাল্টি রেসকোর্সে ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম ছিদ্দিকী ও ঢাকসুর জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন সম্মেলনের ডাক দিলেও মূল সম্মেলন ছিলো পল্টনের কানায় কানায় পূর্ণ। আর এই আয়োজনের হিডেন কারিগর ছিলেন স্বাধীনতার রুপকার সিরাজুল আলম খান (দাদাভাই) । ১৯৭২ সালের ৩১ শে অক্টোবর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের আত্মপ্রকাশ। সারাদেশে জাসদের জয়জয়কার অবস্থায় জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন জনতার মুজিব।
দেখতে দেখতে শেখ মুজিব তাঁর একান্ত ভাজনদের নিয়ে একটি সরকার গঠন ছিলো সম্পূর্ণ বেআইনি। যেখানে একটি গণভোট আয়োজন জরুরী ছিলো। কারণ শেখ মুজিব সহ আওয়ামী লীগের নেতারা পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচিত ছিলেন। এখন পাকিস্তান নেই নির্বাচন কমিশনও নেই, পরিষদে শপথবাক্য পাঠের বিচারালয়ও নেই। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন দেশের নতুন ম্যান্ডেট ছিলো অপরিহার্য আইনী ব্যবস্থা। তা না করে একজনের শুধুমাত্র আংগুল ইশারায় ছিলো আইন। মুজিবের ছেলে, ভাগ্নে, বোন জামাইসহ আপনজনের দাপটে সবাই ছিলো অসহায়। স্বজনপ্রীতির এই সকল বিষয়ে ছাত্রনেতাদের সাথে টেষ্ট টিউব সরকারের বিরোধ মাথা ছাড়া দেয়। এরপর নানা বাদ প্রতিবাদ ও বিদেশী চাপে শেখ মুজিব ও তাঁর সরকার তড়িঘড়ি করে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চে পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সাথে নির্বাচন করেও জাতির মহান নেতাকে ভোট কারচুপির আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। যাকে বলা যায় বিরোধীদলহীন সংসদ। এরপর একদিকে ভারতীয়দের আধিপত্য ও লুটপাট অপরদিকে বিদেশীদের সাহায্য রিলিফ চুরির মহোৎসব। এক বছরের মাথায় দেশে দূর্ভিক্ষে দুই লক্ষাধিক বনি আদমের অকাল মৃত্যু হলেও মুজিব পুত্রের বধূবরন হলো সোনার মুকুট দিয়ে।। পত্রিকায় ছবি ছাপায় বস্রাভাবে বিবাহ যোগ্য বাসন্তীদের ছেঁড়া জাল পরে লজ্জা ডাকার ছবি ও ডাস্টবিনে খাদ্য নিয়ে মানুষ আর কুকুরের লড়াই দেখে অসহায় জনতা। চারিদিকে শুধু দখল বাজি, লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি, হাইজ্যাক রাহাজানিসহ অনিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলায় জাতীয় নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে সংসদে মহা উল্লাস। অল্পদিনের মাথায় ২৫ শে জানুয়ারী মাত্র পাঁচ মিনিটেই ঘৃণিত বাকশাল পদ্ধতি কায়েম নিজেকে এক নেতা এক দেশ ঘোষণা। দেশকে ৬০টি অঞ্চলে বিভক্ত করে ৬০ জনকে গভর্নর ঘোষনা দিলেন। সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে চারটি সরকারী পত্রিকা বাদে সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হলো। বিরোধী দল দমনে রক্ষিবাহিনী তৈরী করে সারা দেশে জাসদের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা হুলিয়া দিয়ে দমনপীড়নে রাজনৈতিক দলের কর্মিরা এলাকা ছাড়া হয়ে আত্মগোপনে। এই নৃসংশতায় জাসদের ৩০ হাজার কর্মিকে হত্যা করা হলো। আ স ম আবদুর রব, মেজর এম এ জলিল, সিরাজুল আলম খান শাহজাহান সিরাজ হাসানুল হক ইনুসহ লক্ষাধিক নেতা কর্মীদের ঠিকানা ছিলো জেলখানা। এই জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পেতে মানুষ রোজা রেখেছিলো। আমাদের মতো তরুণদের ঠিকানা ছিলো বনে জঙ্গলে ফেরারী হয়ে।
একক ক্ষমতাধর শেখ মুজিব কাউকে পরোয়া করতেননা। এমনকি তাঁর মন্ত্রীসভার সবাইকে আপন কর্মচারীদের ন্যায় আদেশ নিষেধ করতেন। এই সকল ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপট সেনাবাহিনীর উপরেও চলেছিল। বিক্ষুব্ধ সেনাবাহিনীর অফিসার মুখ বুঁজে থাকলেও ছিলো চরম অসন্তোষ। যার ফলে একজন সেনা অফিসার মেজর ডালিমের স্ত্রীর অপমান সহ্য করতে পারেনি সেনাবাহিনী। ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট এক অভ্যুত্থানে স্বপরিবারে নিহতের পর ছিলো জাতির নাজাত দিবস। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর একই শাসনের চিত্র দেখেছে আজকের তরুণ প্রজন্ম সে-ই তথাকথিত মহান নেতার ঔরশজাত মেয়ে হাসিনার শাষন। সময়ের সাক্ষী এই পরিবার ছিলো এই দেশের মানুষের জন্য এক অভিশাপ।
( হাফিজ ছিদ্দিকী – মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক, সংগঠক এবং ঢাকা গ্যাজেট এর উপ-সম্পাদক)