সাঈদ তারেক : শেখ হাসিনা ১৫ বছরে কত রাম-শ্যাম যদুমধূকে এমপি মন্ত্রী বানিয়েছে কখনও খবর নেই নাই। রাজা বাদশাদের রাজত্বে মানুষ রাজারাজরা বড়জোড় তাদের আত্মীয় পরিজনদের খবর রাখে, চাকর বাকর বা পাইক পেয়াদাদের না। তবে নুরুল মজিদ হুমায়ুন নামে একজন মন্ত্রী আছেন মাঝেমাঝে কাগজে দেখতাম। এই হুমায়ুন যে ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ব্যাচমেট হুমায়ুন কখনও জানতাম না। জানলাম কাল হাসপাতালে কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুর পর, বন্ধু শাহ জালাল ফিরোজের এক পোস্টে। আমরা যারা ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তী হয়েছিলাম তারা একটা সংগঠন করেছি। সর্তীর্থ ’৬৯। ফিরোজ তার সাধারন সম্পাদক, সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর এইচ এস মনসুর। আমি নির্বাহি কমিটির সদস্য। প্রয়াত হুমায়ুনও একজন সক্রিয় সদস্য ছিল।
প্রসঙ্গটা এলো যখন একটু বলে নেই। আমাদের ব্যাচের অনেকেই পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন পেশায় বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারি হয়েছেন। অনেকেই স্বনামধন্য। ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা ছিল আমার ক্লাশমেট। রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল স্বাধীনতার আগে থেকেই। আমাদের ব্যাচের অনেকেই রাজনীতি করতো, তবে হুমায়ুন কবে থেকে জানতাম না। আমাদের সতীর্থ প্রয়াত শহিদুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান ছিল। আর এক সতীর্থ ছিল সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, কবি শামিম আজাদ, আলী ইমাম, অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ, নরেশ ভূইয়া, আফরোজা বানু, এক সময় বিটিভির জনপ্রিয় নিউজ কাষ্টার মাহমুদা ফিরোজ, অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে প্রয়াত শেখ কামাল, রাজনীতিক শেরিফা কাদের, বিজয় কী-বোর্ডের কেলিওগ্রাফার হামিদুল ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুল করিম সাবু, মোস্তফা কামাল মজুমদার, বিচারপতি ফারুকসহ আরও অনেকে- এই মূহুর্তে যাদের মনে করতে পারছি না। সবাই যার যার কাজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
আরও একজনের নাম উল্লেখ করছি, বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর, যিনি বর্তমানে থানা পুলিশ এবং জেলখানার মন্ত্রী। ব্যপারটা কেমন ড্রামাটিক না! এক বন্ধু পুলিশের মন্ত্রী আর এক বন্ধু তারই পুলিশের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়া অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত! লাশের হাতেও হ্যান্ডকাফ! হায়! পুলিশের কি রসিক বিবেচনা, লাশটা উঠে যদি দৌড় দেয়! আমি এমনটা মনে করি না যে জাহাঙ্গীর হুমায়ুনকে চিনতেন না। হুমায়ুন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তারই একজন ব্যাচমেট এবং একই সংগঠনের সদস্য, এটাও তার না জানা থাকার কথা না। মৃত্যুশয্যায়ও যে তার পুলিশ, বন্ধুকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে রেখেছে হয়তো এটাও মাথায় আসে নাই, বা এলেও হয়তো তার কিছু করার ছিল না! কথায় বলে আইন ইজ আইন। এ কেমন আইন!
ছবিটা ভীষণভাবে ভাইরাল হয়েছে। বিষ্ময়কর এবং অমানবিক। সোস্যাল মিডিয়ায় ছি:ছি: রব। এতে সরকারের বোধবিচার আক্কেল বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন দৃশ্য আমরা শেখ হাসিনার আমলে প্রায়ই দেখেছি। সে ছিল স্বৈরাচার, বুরবুক। কিন্তু নোবেলজয়ী একজন বিদ্বান পন্ডিত শাষকের আমলে সে দৃশ্য দেখবো কেন! শেখ হাসিনার সময় অশীতিপর বৃদ্ধকে হাতেপায়ে ডান্ডাবেরী লাগিয়ে কোর্টে আনা নেওয়া, হাসপাতালের বেডে গুরুতর রোগী আসামীকে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বেঁধে রাখা, বাবা বা মায়ের জানাযায় যেতে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া আসামীকে ডান্ডাবেরী লাগানো- এগুলো ছিল কমন দৃশ্য। জামাত নেতা মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে হাসপাতালে নিয়ে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে, এমন অভিযোগ আছে। গোলাম আজম সাহেবসহ জামাতের আরও কয়েক নেতা জেলখানায়ই মারা গেছেন। শুধু তাই না, শুধুমাত্র প্রতিহিংসার বশে বয়োবৃদ্ধ প্রফেসর ইউনুসকে ইচ্ছা করে লিফ্ট বন্ধ রেখে আদালত ভবনের পাঁচ তলা পর্যন্ত হাঁটিয়ে ওঠানো নামানো হয়েছে। আমরা তখন এমন প্রতিটি অমানবিক ঘটনার নিন্দা করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি। শেখ হাসিনার শাষনের অবসানের পর সঙ্গত কারনেই আশা করা গেছিলো এ ধরনের অমানবিকতা বন্ধ হবে। মামলার আসামী বা অভিযুক্তরা- যে দলেরই হোক, মানুষের মর্যাদা পাবে। বয়ষ্ক অসুস্থ বা সিনিয়র সিটিজেনরা অন্তত: বয়স অনুযায়ী মর্যাদাটা পাবে।
সেটা হয় নাই। চৌদ্দ মাস হয়ে গেছে শুধু হাঁক ডাক আর হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা! সরকারের ‘হুজুরে খামাখা’রা সংষ্কারের ডিমে তা দিয়ে চলেছে, অথচ এইসব ব্যবস্থাগুলো মানবিক করতে কয়েকটা আদেশ অধ্যাদেশই যথেষ্ঠ ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজবন্দী কথাটা সরকারের অভিধান থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ছিল, এমনকি ঔপনিবেশিক বৃটিশ আমলেও। তারা রাজনীতিকদের সম্মান করতো। জেলে নিয়ে গেলেও নাম হতো রাজবন্দী। রাজবন্দীদের থাকতো আলাদা মর্যাদা কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা। মামলা হতো রাজদ্রোহ রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে। বঙ্গবন্ধু কোন অপজিশন সহ্য করতে পারতেন না। বিরোধীতাকারিদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না, শত্রুজ্ঞান করতেন। ধরে ধরে জেলে পাঠাতেন, লাগিয়ে দিতেন ক্রিমিনাল কেস, অথচ পাকিস্তান আমলে নিজে যতবার বন্দী হয়েছেন রাজবন্দীর মর্যাদা পেয়েছেন। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি কোন রাজবন্দী মানতেন না। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এরশাদ সাহেব বেগম জিয়া শেখ হাসিনা- যিনিই দেশ চালাতে এসেছেন একই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চুরি ডাকাতি খুনখারাপি এমন কি রেপ কেসের অভিযোগ দিয়ে জেলে আটকে রেখেছেন। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে দেশে কোন রাজবন্দী ছিল না, অথচ বন্দীদের অর্দ্ধেকের বেশী থাকতো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। এবং সবাইকে রাজনীতি করার দায়েই আটকে রাখা হতো। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারনে একবার এক খাইষ্ট্যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (আল্লাহ তাকে দোজখ নসীব করুন) আমাকে কিছুদিন জেলে আটকে রেখেছিল, অভিযোগ দিয়েছিল গুলিস্তান এলাকার ফুটপাথ হকারদের ফল লুটের!
এই যে মরনোন্মুুখ হুমায়ুনের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো, আইনগতভাবে জাহাঙ্গীরের কিছু করার ছিল কি জানি না, তবে বন্ধু হিসেবে মরদেহটার প্রতি সুবিচার করতে পারতো। হুমায়ুন একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আরো জেনে অবাক হলাম, কারা নাকি পরিবারকে ফোন দিয়ে হুমকী দিয়েছে, লাশের দাফন যেন ঘরের মধ্যে করা হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অন্তত: এই ফোনদাতাদেরকে খুঁজে বের করতে পারেন। পরলোকগত বন্ধুর পরিবারের প্রতি সহমর্মীতার জন্য না হলেও একটা ভাল দৃষ্টান্ত কায়েমের জন্য এটা করা উচিত বলে মনে করি।
এই সরকারই শেষ সরকার না। কখন কাকে কোন অভিযোগ মাথায় নিয়ে জেলে যেতে হয় কেউ বলতে পারে না। অন্তত: এমন কিছু ব্যবস্থা বা পদ্ধতি সেট করে যাওয়া উচিত যাতে নতুন যারা জেলে ঢুকবেন যেন সেখানে গিয়ে একটু স্বস্তি পান। মানবিক মর্যাদা লাভ করেন। বা মনে করেন ভাগ্যিস ব্যবস্থাটা করে এসেছিলাম! এমন কিছু করেন যাতে মানুষ বলতে পারে ইউনুস সরকার দেশের এইএই ভালগুলো করে দিয়ে গেছে। ওইসব সংষ্কারের ভংচং মানুষ মনে রাখবে না, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কি কি পক্ষে এলো তা দিয়েই সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ণিত হবে।
এই যে শেখ হাসিনার সরকারের বাঘাবাঘা পারিষদবর্গ- পিঠমোরা করে হাতে হ্যান্ডবাফ মাথায় পুলিশের হেলমেট বুকে-পিঠে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মান্ধাতা আমলের সেই চোর ডাকাত আনা-নেওয়ার প্রিজন ভ্যানে করে জেল টু কোর্ট ভ্রমন করেন- দেখতে ভাল লাগে না। খুব বেশীদিনের কথা না। স্মৃতিতে এখনও অমলিন। এই ব্যবস্থাগুলো তারাই চালু করেছিলেন। বিএনপি জামাতের বন্দী নেতাকর্মীদেরকে এভাবেই জেল থেকে আনা নেওয়া করা হতো। প্রিজন ভ্যানগুলোও উন্নত করেন নাই। অমানবিক ব্যবস্থাগুলো বদলান নাই। ভেবেছিলেন নিজেরা কি কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন! কেয়ামত পর্যন্ত তো বিএনপি জামাতের লোকেরাই ভুগবে। কিন্তু কথায় আছে আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর! এখন আর হা হুতাশ করেও লাভ নাই।
সে জন্যই বলছি, পরের টার্মের জন্য যারা অপেক্ষমান তাদের কাউকে যেন ভবিষ্যতে আফসোস করতে না হয়- অন্তত: সে ব্যবস্থাটা করে রেখে যাওয়া জরুরী! আর কোন লাশের হাতে যেন হ্যান্ডকাফ লাগাতে না হয়- আইন বদলান!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক